বুধবার 22 শাওয়াল 1445 - 1 মে 2024
বাংলা

ধার প্রদান সংক্রান্ত বিধি-বিধান

প্রশ্ন

ধার প্রদান বলতে কী বোঝায়? এর বিধি-বিধান কী?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

ফকীহরা ধার প্রদান-এর সংজ্ঞায় বলেছেন: উপকার গ্রহণের বৈধতা আছে এবং উপকার গ্রহণের পর মালিকের কাছে ফেরত দেয়া যায়; এমন জিনিস থেকে উপকৃত হওয়ার অনুমতি প্রদান।

এই সংজ্ঞার মাধ্যমে ধার প্রদান থেকে এমন জিনিসগুলো বাদ পড়ে গেল যেগুলোর অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করা ছাড়া সেগুলো থেকে উপকৃত হওয়া যায় না। যেমন: খাদ্যদ্রব্য ও পানীয়।

কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা অনুসারে ধার প্রদান শরিয়তে বৈধ।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর প্রয়োজনীয় গৃহসামগ্রী (অন্যকে) দেয় না।” তথা যে সকল জিনিস মানুষ একে অপরের মাঝে আদানপ্রদান করে থাকে। তাই এখানে সে সকল লোকদের নিন্দা করা হয়েছে যারা এমন জিনিস কেউ ধার চাইলে তাকে নিষেধ করে দেয়।

যে আলেমরা ধার দেওয়াকে ওয়াজিব মনে করেন তারা এই আয়াত দিয়ে দলিল পেশ করেন। এটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রাহিমাহুল্লাহুর অভিমত সেই ক্ষেত্রে যদি জিনিসটির মালিকের সেটি দরকার না থাকে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু তালহাকে দেয়ার জন্য একটা ঘোড়া ধার করেছেন। আর সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার কাছ থেকে কিছু ঢাল ধার করেন।

যার প্রয়োজন তাকে জিনিস ধার দেওয়া নেকীর কাজ। এর মাধ্যমে প্রদানকারী বিপুল নেকী অর্জন করেন। কারণ এটি কল্যাণ ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সাহায্য করার অধিভুক্ত।

ধার প্রদান সঠিক হওয়ার জন্য চারটি শর্ত রয়েছে:

প্রথম শর্ত: ধারদাতা দান করার উপযুক্ত হওয়া। কারণ ধার দেয়ার মধ্যে এক ধরনের দান রয়েছে। তাই কোনো শিশু, পাগল আর নির্বোধের ধার দেয়া সঠিক হবে না।

দ্বিতীয় শর্ত: ধারগ্রহীতা দান গ্রহণের উপযুক্ত হওয়া। অর্থাৎ তার গ্রহণ করাটা সঠিক হওয়া।

তৃতীয় শর্ত: ধার হিসেবে প্রদত্ত জিনিসের উপযোগ মুবাহ তথা বৈধ হওয়া। তাই মুসলিম দাসকে কাফেরের কাছে ধার দেয়া বৈধ হবে না। শিকারকৃত পশুকে ইহরাম অবস্থায় থাকা ব্যক্তির কাছে ধার দেওয়া বৈধ হবে না। কারণ আল্লাহ বলেন: “তোমরা পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অন্যকে সাহায্য করবে না।

চতুর্থ শর্ত: ধারযোগ্য জিনিসটি এমন হবে যে, ব্যবহার করার পরও জিনিসটির মূল অস্তিত্ব অটুট থাকে; যেমনটি আগেও বলা হয়েছে।

ধারদাতা ব্যক্তি ধারের বস্তু যখন ইচ্ছা তখন ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার রাখেন; তবে যে অবস্থায় ফিরিয়ে নিলে ধারগ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত সেই অবস্থা ছাড়া। যেমন: কেউ জিনিসপত্র বহন করার জন্য জাহাজ ধার দিলেন; জাহাজ সমুদ্রে থাকা অবস্থায় তিনি সেটা ফেরত নেয়ার অধিকার নেই। অনুরূপভাবে কেউ একটা দেয়ালের উপর কাঠের প্রান্ত স্থাপনের জন্য সেটা ধার দিলেন। তাহলে যতক্ষণ তাতে কাঠের প্রান্ত স্থাপিত রয়েছে ততক্ষণ দেয়াল ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।

ধারগ্রহীতার উপর ধার হিসেবে গৃহীত জিনিসকে নিজের সম্পদের চাইতেও যত্ন ও গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ করা আবশ্যক; যাতে করে সেটি নিরাপদ অবস্থায় মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তোমরা আমানতসমূহকে সেগুলোর প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও।” উক্ত আয়াত প্রমাণ করে যে আমানত ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক। তন্মধ্যে রয়েছে ধারকৃত জিনিস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাকে যিনি আমানত দিয়েছেন তাকে তার আমানত দিয়ে দাও।” শরয়ী দলিলসমূহ প্রমাণ করে, একজন মানুষকে যে বিষয় আমানতস্বরূপ দেওয়া হয়েছে সেটা সংরক্ষণ করা এবং মালিকের কাছে নিরাপদ অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক। দলিলগুলোর ব্যাপকতার মধ্যে ধারের জিনিসও অন্তর্ভুক্ত। কারণ ধারগ্রহীতা এখানে আমানতদার। আমানতটি সে ফেরত দিতে বাধ্য। প্রচলিত রীতি-নীতির সীমারেখার ভেতরে তাকে উপকার গ্রহণের বৈধতা প্রদান করা হয়েছে। তার জন্য এটা ব্যবহারে এতটা সীমালঙ্ঘন বৈধ নয় যে সে ঐ জিনিসটাই নষ্ট করে ফেলবে। আবার এমন ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারবে না যেখানে এটা ব্যবহার করা অনুপযুক্ত। কারণ জিনিসটির মালিক তাকে এর অনুমতি দেয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম ছাড়া আর কী হতে পারে?

যে কাজের জন্য ধার দেওয়া হয়েছে এর বদলে ভিন্ন কিছুতে ব্যবহার করতে গিয়ে যদি জিনিসটি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ধারগ্রহীতার ওপর ক্ষতিপূরণ দেয়া আবশ্যক। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “হাতের ওপর ঐ বস্তুর দায়বদ্ধতা রয়েছে যা সে গ্রহণ করেছে; যে পর্যন্ত তা প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে না দেওয়া হয়।” হাদীসটি পাঁচজন গ্রন্থকার সংকলন করেছেন এবং হাকেম সহীহ বলেছেন। এ হাদিসটি প্রমাণ করে যে, ব্যক্তি অন্যের মালিকানাভুক্ত যে জিনিস হস্তগত করেছে সেটা ফিরিয়ে দেওয়া তার ওপর আবশ্যক। জিনিসটি মালিকের কাছে বা মালিকের প্রতিনিধির কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত সে দায়মুক্ত হবে না।

আর যদি সচরাচর যেভাবে ব্যবহার করা হয় সেভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে সেটি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ধারগ্রহীতাকে এর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কারণ ধারদাতা তাকে এটা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। আর ‘অনুমতিপ্রদত্ত বস্তুর উপর আপতিত ক্ষতির ক্ষতিপূরণ নেই।’

ধারের বস্তু যে কারণে ধার নেওয়া হয়েছিল, তার চাইতে ভিন্ন কারণে যদি ধারগ্রহীতার হাতে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে কি এর ক্ষতিপূরণ দিবে কিনা সেটা নিয়ে আলেমদের মাঝে মতভেদ আছে। একদল আলেম মনে করেন তার জন্য এর ক্ষতিপূরণ দেওয়া আবশ্যক, সে সীমালঙ্ঘন করুক কিংবা না করুক। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হাতের উপর ঐ বস্তুর দায়বদ্ধতা রয়েছে, যা সে গ্রহণ করেছে; যে পর্যন্ত তা প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে না দেওয়া হয়।” যেমন: যদি পশু মারা যায়, কাপড় পুড়ে যায় কিংবা ধারকৃত বস্তু চুরি হয়ে যায়। অন্য একদল আলেমের মতে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন না করলে সেটার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। কারণ সীমালঙ্ঘন ছাড়া ক্ষতিপূরণ দিতে হয় না। সম্ভবত এটা প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত। কেননা ধারগ্রহীতা মালিকের অনুমতিতে এটা হস্তগত করেছে। সুতরাং এটা তার কাছে আমানত বলে গণ্য।

তবে ধারগ্রহীতার দায়িত্ব ধারের বস্তু সংরক্ষণ করা, যত্নের সাথে দেখভাল করা এবং তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মালিকের কাছে দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়া। ধারের বস্তুর ব্যাপারে কোনো অবহেলা না করা কিংবা নষ্ট করে না ফেলা। কারণ এটা তার কাছে আমানত। আর ধারদাতা তার প্রতি অনুগ্রহ করেছে। “আর উত্তম কাজের প্রতিদান কি উত্তম কাজ ছাড়া আর কিছু হতে পারে?”

সূত্র: শাইখ সালেহ আল-ফাওযানের ‘আল-মুলাখখাস আল-ফিকহী’ বই